বন, পাহাড়, নদী আর ড্রাগনের গল্প (ভুটান ভ্রমণ পর্ব ২)
(১ম পর্বের পর) বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম, থিম্পুতে আমাদের আরেকটি অন্যরকম অভিজ্ঞতা ছিল Thimphu Traditional Arts School এ যাওয়া। ছাত্র ছাত্রীরা তাদের traditional painting, sculpting, wood curving, weaving করছিল, মনে হচ্ছিল এত পর্যটকের আনাগোনাও তাদের মনোযোগ একটুও বিঘ্নিত করতে পারি নি। কেউ sculpting এ একমনে কাজ করে যাচ্ছে, আবার কেউ মায়াবী পাহাড়ি সুরে গান গেয়ে গেয়ে কাপড় বুনছে। গল্পের মত শুনালেও বিশ্বাস করুন, একটু ও বাড়িয়ে বলছি না! আমার মনে হচ্ছিল হয়ত ২০০/৩০০ বছর আগে আমাদের ও একেবারেই নিজস্ব ঐতিহ্য ছিল, চাইলে আমরাও গর্ব করে তাকে আঁকড়ে রাখতে পারতাম।
এর পর আমরা Paro শহরে গেলাম। পথে Chime Lhakhang (fertility temple) গেলাম ধান ক্ষেত আর উঁচু নিচু টিলা পার হয়ে। প্রায় ৪০ মিনিটের এই hiking এ ভুটানি গ্রামের জীবন যাত্রাটা বুঝা যায়, উপভোগ করা যায়। পারো তে আমরা Rinpung Dzong (Paro Dzong) আর Ta Dzong (National Museum) গিয়েছিলাম। ভুটানিদের জীবনের সাথে পাহাড় এমন ভাবে মিশে আছে, যেকোনো কিছু দেখতে হলেই পাহাড়ে উঠতে বা নামতে হয়। এই দুইটা জায়গাও টাই। Ta Dzong এ গিয়ে আমরা তাদের ইতিহাস, পুরো দেশের ব্যপারে ভাল ধারনা হয়েছে। Drukgyal Dzong এও গিয়েছিলাম আমরা। এই দুর্গটি অনেক পুরানো, অনেকটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে এখনো ঐতিহ্য আর সৌন্দর্য ধরে রেখেছে।এই দুর্গটি তিব্বতী আর মঙ্গলদের আক্রমন থেকে ভুটানি দের রক্ষা করতে যুদ্ধের জন্য ব্যবহৃত হত। চেন চো আমাদের সুন্দর করে এই ইতিহাস বর্ণনা করেছিলেন।
পারো শহর টা ও অবশ্যই পাহাড়ি, তবে মনে হচ্ছিল থিম্পু বা পুনাখার থেকে একটু কম, আর ব্যস্ত ও বেশি। একটু সমতল বলেই হয়ত এয়ারপোর্টটা এখানে। খাবার দোকান আর হোটেল চোখে পরে বেশ। পারো শহরে হেঁটে বেড়াতে গিয়ে মজার এক অভিজ্ঞতা হল আমাদের। এই দেশের জাতীয় খেলা হল archery। এই খেলাটা তাদের হৃদয়ে গাথা। আমরা পুনাখাতে দেখেছিলাম বাচ্চাদের archery খেলতে। খুব luckily আমরা এখানে একটা archery ground এ একটা friendly match দেখতে পারলাম। অসাধারন লেগেছিল। এই দেশে কেউ ক্রিকেট দেখে না, আমাদের কাছাকাছি অন্যরকম একটা দেশ যাদের কোন ক্রিকেট উন্মাদনা নাই।
Haa valley পারো থেকে ৪ ঘন্টার দূরত্বে খুবই ছোট্ট একটা শহর। যাওয়ার রাস্তাটা অনেক উঁচু তে। আরেক টু ঠাণ্ডা পড়লেই বরফে ঢেকে যায়। আমরা যাবার সময় বরফ দেখতে পেলাম। Chele La pass হচ্ছে ভুটানের সবচেয়ে উঁচু রাস্তা (13000 ft) যেদিক দিয়ে মোটরযান যেতে পারে। রাস্তাটা এত উঁচু যে আমরা একবার যখন গাড়ি থেকে নামি তখন আমাদের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল (altitude sicness)। রাস্তার পাশে তাপ আর সুন্দর গন্ধের জন্য ওরা হেমলক নামের একটা পাতা পোড়ায়, তাদের মতে এই গন্ধ টা বাতাস বিশুদ্ধ করে। বিশুদ্ধ করে কিনা জানি না, তবে সত্যি সুন্দর গন্ধ। অনেকেই সেখানে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে প্রেয়ার ফ্লাগ লাগিয়েছে, কেউ মৃতের আত্মার শান্তির জন্য, কেউ goodwill এর জন্য।তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী প্রেয়ার ফ্লাগ যত উঁচু তে লাগানো হয় ততো পুন্য, এজন্য ভুটানের এই ভীষণ উচুঁ রাস্তা গুলতে অনেক সাদা আর রঙিন প্রেয়ার ফ্লাগ চোখে পড়বে। কখনো একদম ঘন পাইন বন, আপেল বাগান, গ্রাম, আবার কখনো ইয়াক (গরুর মত একটা প্রাণী যারা অনেক ঠাণ্ডায় থাকে) এর পাল দেখে আমরা অবশেষে হা তে পৌঁছলাম। ছোট্ট উপত্যকা টা এত শান্ত, মনে হয়েছিল জীবন টা এরকম একটা জায়গায় কাটিয়ে দিতে পারলে মন্দ হত না। আমরা হা তে হেঁটে বেড়িয়ে, দুপুরের খাবার খেয়ে ফিরে চললাম পারোর উদ্দেশে। আমি অনেক গুলো শুকনো পাইন ফল কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিলাম, রঙ করে বাসায় সাজিয়ে রেখেছি। ওদের দেশে এটা দেখে খুব ভাল লেগেছিল আমার।
আমাদের ট্রিপের একদম শেষ দিনে Trekking এ গিয়েছিলাম Taktsang (Tiger Nest monastery)এ। ৩ ঘণ্টা হেটে পাহাড়ের মাথায় এই monastery টা তে যাওয়া যায়। শুরুতে উচ্চতা ৭০০০ ফুট, আর মাথায় উচ্চতা ১০০০০ ফুট, বেশ খানিক টা পথ আর খাড়া ও বেশ । pine আর oak forest এর মাঝে দিয়ে পাহাড়টায় উঠতে হয়। এত শান্ত যে পাতার ঝিরি ঝিরি শব্দ টা পর্যন্ত শোনা যায়। ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে আমরা যখন পৌঁছলাম খাড়া পাথুরে পাহাড় টার চুড়ায় একদম গা ঘেষা মন্দির টায়,পুরো pine ফরেস্ট টা দেখা যাচ্ছিল ওখান থেকে। কি সুন্দর জায়গাটা। মনে হচ্ছিল, এই নিরবতায় একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে লোকালয় ভাল লাগানো কঠিন হয়ে যাবে। মন্দিরের পাশেই একটা বিশাল ঝরনা, ভিতরে এক টা গুহা ও আছে। প্রকৃতির এত কাছাকাছি এসে জীবনের প্রাপ্তির সংজ্ঞাটাই বদলে যায়।
ভুটান ট্রিপে কোনো তাড়াহুড়া ছিল না আমাদের, অনেক স্পট ঘোরার কোন টার্গেট ও ছিল না, তাই প্রকৃতির খুব কাছাকাছি যাবার সুযোগ হয়েছিল। এত শান্ত, শান্তিময় জায়গা টা, এক মনে ঝরনা আর জংগলের শব্দ শুনে দিন কাটিয়ে দেয়া যায়। শুনে অবাক হয়েছি, এত বন এই দেশে, অথচ চাইলেই গাছ কাটা যায় না। এমন প্রকৃতি প্রেমী জাতি বলেই প্রকৃতি এখানে প্রকৃতির মতই আছে।
এক রাশ ভাল লাগা নিয়ে পরদিন সকাল ৯ টার ফ্লাইট এ আমরা দেশে ফিরি। ভেবেছি সম্ভব হলে আবার যাব, Bumthang, Wangdu কত জায়গাই তো যাওয়া হলো না এবার! বন, পাহাড়, নদী আর ড্রাগনের এই দেশের কথা মনে থাকবে আজীবন। কাদিনচে (ধন্যবাদ) লা ভূটান!