শিলং, চেরাপুঞ্জি ও আরও অনেক কিছু! – ৪ দিন ৩ রাত
ভেবেছিলাম দাদাদের সাথে দুর্গাপূজা দেখবো, কিন্তু পাসপোর্টের নাকি কাগজ শেষ হয়ে গিয়েছে – ৩ তারিখ এর পাসপোর্ট পেলাম ১৪ তারিখ। গল্পের শুরুটাই হয়ত থাকতো না যদি ভিসা প্রিন্ট এর কালি শেষ হয়ে গিয়েছে, এইটার জন্য ভিসাটা সময় মতন না পেতাম। ১৬ তারিখ এর প্ল্যান বদলে ২৩ তারিখ হল, শর্ত যুক্ত হল – with or without me। বাঁধন ভাই এর Mandatory leave নেয়া done, অন্যদিকে ফাহিম, রাকিব এর ক্লাস খুলে যাচ্ছে।যেহেতু ট্যুর এ যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা, তাই এদিক ওদিক থেকে বিভিন্ন কাজ আসতেই থাকবে। ২৩ তারিখ সকাল থেকেই বিশাল এক প্রোজেক্ট প্রপোজাল এর কাজটা ঝড়ের গতিতে আগাইতে না আগাইতে দেখি ৩ টা বাজে।পাসপোর্ট আনতে পাঠাও চেপে সোজা যমুনা ফিউচার পার্ক এ। স্রষ্টার কি অশেষ কৃপা! আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম।সিলেটের টিকিট যত রাতের হোক কাটা হোক, এইটা বলে দিলাম ফাহিমকে। আমি আবার অফিস এসে বাকি কাজ সারতে সারতে ১০ টা বাজালাম। সিএনজি চেপে বাসায় এসে ব্যাগ গুছায় নিয়ে বের হলাম।হানিফ এর ৪০ সিটের বাস, তাই পা টা কেটে হাতে নিলেও হতো, কিন্তু যাত্রা শুরুর পথে নালিশ করতে নেই, তাই সোনামুখেই মেনে নিলাম। Sleeveless T-shirt পরেই ট্যুর করি সাধারনত, কিন্তু মাঝপথে হুডি পরতে বাধ্য হলাম, বেশ ঠাণ্ডা।
১ম দিন
কদমতলিতে নামলাম ৬ টায়। ধুম্রসলাকার সাথে এক কাপ চা, এর পর আরেক বাস এ করে তামাবিল বর্ডার। বেলা তখন ৮ টা, ২৪ অক্টোবার। আগেরদিনেই ভিসা পেয়েছি, তাই Travel Tax দেবার সুযোগ পাওয়ার কথা আসেই না। কিন্তু স্যাররা সহজে মানবেন কিনা, এইটা নিয়ে সন্দিহান ছিলাম আগে থেকেই। কিন্তু সকাল সকাল বেলায় মেজাজ ভালো থাকার সুবাদে, মিষ্টি হাসি দিয়েই ওই বেলা পার পেলাম। পাসপোর্ট এ নানান সিল লাগানোর পর ওইপাড়ে গেলাম ৯ টার মধ্যেই। ট্যাক্সি নিয়ে রওনা হলাম শিলং এর পথে। দাগের এপার আর অপার, কিন্তু সাথেই সাথেই সব বদলে গেল- বাড়ি ঘরের আর্কিটেকচার থেকে ভাষা, খাবার দোকান থেকে সব। শুধুমাত্র PRAN লিচি দেখে, “আরে এইটাতো আমার দেশের” – এই Feel টা নিচ্ছিলাম। পথের মাঝে একটা Viewpoint এ থেমেছিলাম। দাঁত ভেঙ্গে আসবে এমন একখান নাম – Mawjngih Lapynshongdor View Point. আসেপাশের পাহাড় এবং মেঘের খুলি খুলি ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব টা নেওয়া যায় ওই জায়গা থেকেই। ১০ রুপি দিয়ে অসম্ভব অসম্ভব সব জুস আর চিপস কিনে কিনে খাওয়ার অভ্যাস করতে লাগলাম শিলং যাওয়ার পথেই।
শিলং এ আসতে আসতে সাড়ে ১২ টা বেজে গেল। ফাহিম আর রাকিব হোটেল এর সন্ধানে গেলে, আমি আর বাঁধন ভাই ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মাঝে এলেবেলে ভাষায় কথা বলার মানুষদের দেখে বিদেশ চলে আসছি, এই ফিল নিতে লাগলাম। হোটেল এ চেক ইন করে বের হলাম আবার। Street Food খাওয়ার উদ্বোধন করলাম বাসমতী চালের চিকেন পোলাও দিয়ে। শহর ঘুরে ওই দিন কাটানোর জন্য গেলাম ১৯৩৬ সালে নির্মিত হওয়া Mary Help of Christians Cathedral চার্চ এ। উপরতলার চার্চ এ যেতে November Rain এর মিউজিক ভিডিও এর মধ্যে কিছু সময়ের জন্য ঢুকে গেলাম মনে হল। এত ফিল কোথায় রাখবো, এইটা ভাবতেই মনে হল এখন একটা কফিশপ এ যাওয়া যাক। Dylan`s Cafe তে বব ডিলান এর গান সাথে কফি গিলে আবার নামলাম স্ট্রিট ফুড খেতে। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে, তাই শহরের অলি গলি ঘুরেই কাটালাম বাকিটা সময়। বাঁধন ভাই আর রাকিব এর নাক ডাকার জেমিং এর সুবাদে আলো ফোঁটার আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেল।
২য় দিন
কনকনে শীতের মধ্যে শুধুমাত্র মনের জোরে কম্বল ত্যাগ করে ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেলাম ৬ টার মধ্যেই। ট্যাক্সি ঠিক করলাম তেরনা পর্যন্ত, মাঝে কয়েকটা স্পট ভিসিট। মকদক এর জিপ-লাইনিং ১০ টায় শুরু হবে, তাই করা হল না। Seven-Sisters এ পানি নাই বলে নামলামই না। Masmaw Cave এর ভিতর অনেক্ষন কাটায় দিলাম। ছবি তোলার দারুন কয়েকটা স্পট এবং আল-আধারির খেলা ক্যামেরায় বন্দি করতে আমরা চারজন ই উঠে পড়ে নামলাম। এর পর সোজা তেরনা। বাজে তখন ১২ টা মতন, ২৫ অক্টোবার। শুরু করলাম ৩৭০০ সিঁড়ি নামা। শুরুতে সুন্দরী সুন্দরী দিদি দেখে বেশ জোরে সরে নামা শুরু করলেও পরে দম চলে গেল অবিলম্বেই। ২০০০ সিঁড়ি নামার পর রাকিব তার DSLR ক্যামেরা খুঁজে না পেতে কোনোদিক না তাকায় উপরে দৌড় মারল। পরে পেয়েছিল, লাভের মধ্যে লাভ হল রাকিব এর হাজার খানেক সিঁড়ি বেশি উঠা নামা করা হয়ে গেল। আমরা Nongriat এ Homestay তে রুম নিলাম ৪ টার দিকে। সব কিছুই আছে ওইখানে। ফ্রিজ, টিভি, কফি মেশিন – সাহস করে খালি বলতে পারলাম না – ওয়াইফাই আছে কিনা। Second Suspension ব্রিজ এর নিচে নাম না জানা এক ঝর্ণাতে নামলাম। হি হি করে কাঁপতে কাঁপতেই গোসল করে ঘণ্টাখানিক কাটায় উঠলাম। রাতে আড্ডাবাজি, Twenty Nine আর ঘুম।
৩য় দিন
আবার ৫ টায় উঠা। ৬ টায় বের হওয়া। প্রথমেই Double Dacker, Living Root Bridge. সামনের ছোট Trail টা বেশি মুগ্ধ করতে পারল না, আগের দিনের ওই নাম না জানা ঝরনার জন্য। ফ্যান্টাসি কিংডম এর মতন পাথর সাজায় একটা spot বানাইসে, এইরকম মনে হল। সমাজে মুখ রাখার জন্য ওইখানে ফটোসেশন করে ট্র্যাকিং শুরু করলাম। আগের দিন এর হাজার খানেক সিঁড়ি এক্সট্রা উঠা নামার জন্য রাকিব এর পায়ের অবস্থা খুবই সংকটময়। Natural Swimming Pool এর স্পট এ আসে ঠিক করলাম আগে Rainbow Falls ঘুরে আসবো। রাকিব কে রেখে রওনা হলাম, সামনের রাস্তা পুরাটাই খাড়া পাথর এর। আরও ৪০ মিনিট ট্র্যাকিং করে গেলাম rainbow falls এ। জায়গাটায় এখনও ওইভাবে মানুষজন না যাওয়ায় ঝর্নার পানিতে নামার পথটা সুগম না। আমি আর ফাহিম অনেক চেষ্টা চরিত্র করে পাহাড় বেয়ে নিচে নামলাম, যদিও বেশ রিস্ক ছিল। কিছুক্ষণ পরে দেখি রাকিব চলে আসছে পায়ে ব্যথা নিয়েই। এতটা পথ আসার পর যদি এই ফলস টা না দেখে যায়, তাহলে তো পুরো ট্রিপ তাই বৃথা।ফেরত যাওয়া কথা ভাবতে, সিঁড়ি বেয়ে উঠার কথা মনে আসতেই, বুকের মধ্য খানে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করতে লাগলাম। ব্যাক করার সময়ে Natural Swimming pool কভার করে টানা দুই ঘণ্টা ট্র্যাক করে আসলাম গ্রামে। বেকপেক গুছিয়ে শুরু করলাম ৩৭০০ সিঁড়ি উপরে উঠা। যে ট্যাক্সি আমাদের নিয়ে এসেছিল টার সাথেই কথা ছিল যে সে নিয়ে যাবে। ৩ ঘণ্টা সিঁড়ি বেয়ে উঠার পর উনারে বিমর্ষ মুখে দাঁড়ায় থাকতে দেখলাম। ব্যাক টু শিলং, রাতে ডোমিনস এ পিঁজা খাওয়া, নাক ডাকিয়ে হোটেল এ ঘুম, সকালে উঠে মশলা ধোসা দিয়ে নাস্তা, অনেক অনেক চকলেট এবং বিস্কুট কিনে ফেরত যাওয়ার যাত্রা শুরু করা।
ট্যুর এর প্রতিজনের বাজেটঃ
- ঢাকা থেকে সিলেট – ৪৭০ টাকা প্রতি জন
- সিলেট থেকে তামাবিল – ৬০ টাকা প্রতি জন
- বর্ডার থেকে শিলংঃ ২০০ রূপি প্রতি জন
- প্রথম রাত হোটেল ভাড়া (শিলং) -৪৫০ রূপি প্রতি জন
- দুপুর ও রাতের খাওয়া – ২০০ রূপি প্রতি জন
- শিলং থেকে তেরনা (স্পট ভিসিট সহ) – ৪৫০ রূপি প্রতি জন
- মাস্মাও কেইভ – ২০ রূপি প্রতি জন
- নংরিআট রাতে থাকা – ৩০০ রূপি প্রতি জন
- লাঞ্চ, ডিনার, সকালের খাবার এবং দুপুরে নুদুলসঃ ৩০০ রূপি প্রতি জন
- Double Dacker : ২০ রূপি প্রতি জন
- তেরনা থেকে শিলংঃ ৪০০ রূপি প্রতি জন
- তৃতীয় রাত হোটেল ভাড়া (শিলং) -৪৫০ রূপি প্রতি জন
- রাতের খাবার, পরদিন সকালের নাস্তা, এবং লাঞ্চ – ৩৫০ রূপি প্রতি জন
- শিলং থেকে তামাবিল বর্ডার ট্যাক্সি ভাড়া- ৩৫০ রূপি প্রতি জন
- তামাবিল থেকে সিলেট রিসার্ভ গাড়ি ভাড়া- ৪৫০ টাকা প্রতি জন
- সিলেট থেকে ঢাকা বাস ভাড়া – ৪৭০ টাকা
- সর্বমোট ৫,৫৬৪ টাকা প্রতি জন
The article was originally posted on my facebook profile.