আমাদের হাওড় দেখা – টাঙ্গুয়ার হাওড়, সুনামগঞ্জ
আমার হাওড় ভ্রমণের ইচ্ছা ছিল বহু দিনের । পর্যটনের তেমন কোনো সুযোগ না থাকায় অনেকটা ধরেই নিয়েছিলাম যে যাওয়া হবে না কখনো । ফেসবুকে লোকজনের লেখা পড়ে সাহস পেয়ে গেলাম আর অবশেষে খুব কাছের বন্ধুদের সাথে পরিকল্পনা করে চলে গেলাম এক পূর্ণিমার রাত দেখে।
জুলাইয়ের একদম শেষ শুক্রবারে সিলেট হয়ে রওনা হলাম সুনামগঞ্জের বিখ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওড়ে । সিলেটে নেমে নাস্তা করলাম পানশিতে, সিলেট যাব আর পানশিতে খাব না তা কি হয়? গাড়িতে করে তিন ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম আমরা তাহিরপুরে। সিলেট পাড় হয়ে সুনামগঞ্জে ঢুকতেই দুপাশের দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে থাকলো। অনেক সবুজ, বেশ বিস্তির্ন জলাভুমি আর নাম জানা নাজানা হাওড় । সুনামগঞ্জ যাবার আগে আসলে বইতে পড়া বাদে হাওরের ব্যপারে কোন ধারণা ছিল না, তাই টাঙ্গুয়ার হাওড় আর হাকালুকি হাওড় ছাড়াও যে অসংখ্য হাওড় পুরো কিশোরগঞ্জ, সিলেট আর সুনামগঞ্জ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জানতামই না।
তাহিরপুরে গিয়ে আমরা আগে থেকে ভাড়া করা নৌকার মাঝিকে ফোন করলাম। তাহিরপুর জায়গাটা মুলত বেশ বড় একটা বাজার, একদমই গ্রামের বাজার বলা চলে। থানা আছে একটা, ওখানে আমাদের রেজিস্ট্রেশন করতে হয়েছিল। আমরা নৌকায় উঠে গেলাম সবাই। নৌকার ভিতর টা বেশ নীচু ছিল, কিন্তু জানালা দিয়ে পা ভিজিয়ে হাওরের পানিতে বসার মজাই আলাদা। টাঙ্গুয়ার হাওড় তাহিরপুর উপজেলারই অংশ। একদম বাংলাদেশ ভারতের সীমান্তে একেবারে মেঘালয়ের কোল ঘেষে এই টাংুয়ার হাওর তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিকভাবে। মূলত পুরো এলাকা টা একটা নীচু ভুমি আর সাথে আছে ছোট্ট একটা নদী, অসংখ্য বিল। জায়গাটা চেরাপুঞ্জির একদম কাছে, তাই অনেক বৃষ্টিপাত হয়। পাহাড়ী ঢ্ল নেমে আর বর্ষার তুমুল বৃষ্টিতে হাওরগুলো পানিতে টইটুম্বুর হয়ে যায়। অথচ শীতকালে এই জায়গা গুলো দেখলে বোঝায় যাবে না যে বর্ষায় এই জায়গা গুলো একদম সাগরের মতো লাগে। রীতিমতো ধান চাষ হয় ওখানে! প্রচুর অতিথি পাখি আসে তখন, তাই অতিথি পাখি দেখতে হলে অবশ্যই শীতকালে যেতে হবে। আর যদি অথই সাগরের মত বিশালতা দেখতে চান, তবে অবশ্য বর্ষাকালই উপযুক্ত। বিশ্বাস করুন, একটু ও বাড়িয়ে বলছি না, সত্যি সাগরের মত লাগে। হাওর শব্দটাও কিন্তু সাগরের ই আঞ্চলিক শব্দ।
আমাদের গন্তব্য ছিল টেকেরঘাট। পুরো সময়টাই আমরা কখনো হাওর, কখনো নদী দিয়ে গিয়েছি। মাঝে মাঝে চারপাশে অথই পানি, কখনো ছোট্ট ছোট্ট গ্রামের কোল ঘেঁষে গিয়েছি। সত্যিকারের ছায়াসুনিবিড় গ্রাম, প্রায় প্রতিটা বাড়ির সাথে নৌকা বাঁধা, কারন নৌপথ ছাড়া চলাচলের অন্য কোন মাধ্যম নেই। হঠাৎ শুরু হল সোয়াম্প ফরেস্ট। গাছ গুলো প্রায় এক মানুষ সমান পানিতে ডুবে আছে। আমরা লাইফ জ্যাকেট পড়ে পানিতে নেমে গেলাম। পানি বেশ স্বচ্ছ, ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। ওয়াচ টাওয়ার আছে ওখানে, ছোট ছোট নৌকা নিয়ে বাচ্চারা ঘুড়িয়ে আনে গাছের ফাঁকে ফাঁকে। বেশ সুন্দর একটা সময় কাটিয়ে আর অসম্ভব ক্ষুধা নিয়ে আমরা নৌকায় উঠলাম। দুপুরের খাবার খেলাম হাওড়ের মাঝেই এক গ্রামে। আমাদের মাঝিরা বন্দোবস্ত করেছিল। হাঁসের মাংস, ডাল আর আলু ভর্তা ভাত দিয়ে বেশ ভাল একটা লাঞ্চ। এরপরের গন্তব্য টেকের ঘাট। ওখানে চুনাপাথরের খনি থাকায় পানির রঙ আস্তে আস্তে স্বচ্ছ আর নীল হয়ে গেল। দূরে মেঘালয়ের পাহাড় দেখা যাচ্ছিল। আকাশ, পাহাড় আর হাওড়, সব মিলিয়ে বেশ অন্যরকম এক বাংলাদেশ।
মোটামুটি বিকেল চারটায় আমরা টেকেরঘাট পৌঁছে গেলাম। সীমান্তে আর মেঘালয়ের পাহাড়ের কোলে একটা লোকালয় । পরিতেক্ত একটা চুনাপাথরের খনি আছে এখানে। মূলত একে ঘিরেই বাজার আর লোকালয় বিস্তৃত হয়েছিল এখানে। আমরা এখানে নেমে বারিক্কা টিলা দেখলাম, পাশেই নিলাদ্রি লেক। একাত্তরে বেশ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল, তাই শহীদদের কবর আর স্মৃতিস্তম্ভ ও আছে। আমরা বাইকে করে দেখতে চললাম যাদুকাটা নদী।কখনো গ্রামের সরু রাস্তা, কখনো একদম খেতের আইল দিয়ে অবশেষে আমরা যাদুকাটা নদীর পাড়ে পৌছালাম । এমন একটা স্বচ্ছ নদী বাংলাদেশে আছে আমি না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। দূরে পাহাড়ে ঝর্না, শান্ত নীল নদী, সবুজের সমারোহে অসাধারন একটা যায়গা। বিকেলটা ওখানে কাটিয়ে আমরা গারো পল্লী আর লাক্কাছরা ঝর্না দেখে সন্ধায় টেকেরঘাটে ফিরলাম।
রাতের খাবার খেয়ে নৌকায় চলে আসলাম আমরা টিপটিপ বৃষ্টিতে। কপালে চন্দ্র বিলাস ছিল না, তাই ঝুম বৃষ্টিতে হাওড় বিলাস হল। সন্ধ্যা হতেই ভারতের সীমান্তে ওরা আলো জ্বালায়, সেই আলোর প্রতিচ্ছবি পড়ছিল হাওড়ের পানি তে। নৌকায় গাদাগাদি করে আমরা রাতটা কাটিয়ে দিলাম। পরদিন ভোরে পাহাড়ের ছায়া আর মেঘের হাতছানি কে বিদায় দিয়ে ফেরার জন্য রওনা হই আমরা।
কিভাবে যাবেনঃ ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত বাসে গিয়ে লেগুনা বা গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া যায়। আবার সিলেট পর্যন্ত বাস, ট্রেন বা বিমানে গিয়ে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় টেকেরঘাটে। নৌকা ঘাটে গিয়ে ঠিক করতে পারেন, আবার ঢাকা থেকেও এজেন্সির সাথে কথা বলে ঠিক করে নিতে পারেন।
খরচঃ খরচ আসলে খুব কম। আমরা ৭ জন প্লেনে সিলেট গিয়েছি আর ফিরেছি এ সি বাসে। সিলেট থেকে টেকের ঘাট যাওয়া আসা করেছি ভাড়া করা গাড়িতে। সাথে নৌকা ভাড়া আর খাবার খরচ তো ছিলই। তারপর ও ৭৫০০ টাকা খরচ হয়েছে জনপ্রতি। চাইলে ৫০০০ টাকায় ঘুরে আসা যায়, পছন্দ আপনার।
সুবিধা অসুবিধাঃ নৌকা দেখে না নিলে অনেক স্ময় ছোট নৌকাতে গাদাগাদি হয়ে যেতে পারে। মানুষ জনকে ভাল লেগেছে, আমাদের মাঝিরা বেশ ভাল ছিল। তবে টয়লেটের খুব সংকট এখানে। নৌকায় একটা বেসিক টয়লেট থাকে, আমাদের বেশ কষ্ট হয়েছে খাপ খাওয়াতে। নৌকাতে ঘুমানোর জন্য চাদর নিয়ে যেতে পারেন, কারন ওদের চাদর বা বিছানা আপনার পছন্দ নাও হতে পারে।