কেউ বলে, বুয়েটিয়ানের জীবনে ট্যুর আসে প্রেমের মতো

Posted In: Featured, Traveler's Blog, by on Oct, 18 2014. Leave a Reply

আমি বলি, বুয়েটিয়ানের জীবনের ট্যুর আসে দমকা ঝোড়ো হাওয়ার মতো। কেউ কেউ সাহস করে হাওয়ায় ভেসে চলে যায় অচেনা কোন প্রান্তে, আর কেউ ভাঙ্গা কুটিরের নিশ্চয়তার আশ্রয়ে কাটিয়ে দেয় সারাজীবন।

রতন ভাইয়ের টঙ্গে ট্যুরের লোকেশন আর পলাশে লাইনআপ ফিক্স, ব্রো-গোত্রীয় নতুন সদস্য সংযোজন, এলাকা গরম এবং ব্রো-গোত্রের অন্যান্য সদস্যের মন খারাপ, মাসব্যাপী অপেক্ষা আর ম্যাক্সিমাম লেভেলের প্ল্যানিং।

অবশেষে টানা সাত সপ্তাহের প্যারার পর ২৮ তারিখ রাতে ফকিরাপুল থেকে যাত্রা শুরু। বাসে ড্যানি ব্রো-র সেলফি ম্যানিয়া আর শৌভিকের ডাবল বড়ির ঘুম, লীডারের জানালার সিট দখল আর টর্চ জ্বালায়া টনি ব্লেয়ারের জীবনী পাঠ, বাসে ফিমেইল ব্যাচমেইটের উপস্থিতি নিশ্চিতকরন এবং সকলের লুজার সত্ত্বার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ, যাত্রা বিরতিতে গ্রামীনের ডাবল শর্মা এবং পুরো যাত্রাতেই ড্যানি ব্রো-র বদান্যতায় ড্রাইভারের পাশের জায়গায় ধোঁয়াময় আড্ডা।

ভোরে বাস থেকে নাইমাই দেখি আমাদের চান্দের গাড়ি হাজির। কোনপ্রকার সময় নষ্ট না কইরাই গেলাম চিম্বুক। তারপর পীক সিক্সটি নাইন হয়ে নীলগিরি। পঞ্চাশ টাকার টিকেট উসুল করার ধান্দায় পুলাপান লাইন ধরে দাড়ায়ে গেল টয়লেটের সামনে। আর শিপন ব্রো আবেগের আতিশয্যে টপলেস অবস্থায় জবা ফুল নিয়ে ছবি তুলতে লাগলেন।

atirampara

তারপর একটানে থানছি বাজার। গাইড ম্যানেজ, নৌকা ম্যানেজ, আর্মির কাছে রিপোর্ট, মোবাইল চারজ, দরকারি জিনিসপত্র কেনা, জিনাপাড়ার দুই রাতের বাজার। লাঞ্চ করে তারপর উঠলাম নৌকায়। গন্তব্য রেমাক্রি।

চিকন-লম্বা টাইপের নৌকায় তারপর এপিক দুই ঘন্টা। পাহাড়ি ঢল দেইখা শুরুতে সাঁতার না জানা এই দেহে শিরশিরে একটা অনুভূতি হইতেছিলো। কিন্তু সাথে ভাই-ব্রাদার থাকলে আর কী লাগে? দুই পাশের বিশাল উঁচু পাহাড়ের সারি আর তার মাঝের উত্তাল নদীর উপর দিয়ে আমাদের পাহাড়তলী গমন – মানে, ব্যাপারটা জমে গেছিলো।

পথে রাজাপাথর, কুমারী ঝরনা দেখে বিকালে পৌঁছাইলাম রেমাক্রি। সুন্দর, ছিমছাম জায়গা। কটেজে রুম নিয়ে ব্যাগ রাইখা গেলাম রেমাক্রিখুমে। গোছল করতে।

সন্ধ্যা নামতেই শুভ আর নোমান শুরু কইরা দিল এক চায়ের দোকানীর (বেশ সুন্দরী) সাথে খাজুইরা আলাপচারিতা এবং ফেসবুক আইডি কব্জা করার চেষ্টা। ন্যুডুলস পর্বের পর স্থানীয় পরিবার আমন্ত্রন জানাইলো তাদের ভেতরের ঘরে বসে একটু তরল পানের। স্কিল প্রদর্শনের সুযোগ পায়া লোকজন ধুমছে গেলা শুরু করলো।

লং স্টোরি শর্টঃ ঘন্টাখানেক পরে এক পাঁড় মাতাল তার দুর্গন্ধময় ওষ্ঠদ্বয় দিয়া জোরপূর্বক সবার গালে চুম্বন দিয়া চ্যাচাইতেছে – লাভিউ, ব্রো। রাতে খাওয়ার টাইমের মুহুর্মুহু তরল উদগীরনের কথা নাহয় না-ই কইলাম।

পরেরদিন ভোর থেকে ট্যুরের কঠিন পার্ট শুরু। হাটাপথে প্রথমে নাফাখুম। রাস্তা খারাপ না, প্যারা বলতে শুধু রেমাক্রি খাল মোট তিনবার এপারওপার করা লাগে। নাফাখুমে ফটোসেশন, ঝালমুড়ি গেলা আর গোছলের পর আবার হন্টন শুরু। লক্ষ্য জিনাপাড়া।

নাফাখুম টু জিনাপাড়া রাস্তার একটা অংশ আসলেই বেশি প্যারার। পিছলা পাথর, কাদা, বেসাইজ ঝোপঝাড় আর অফকোর্স – জোঁক।

amiakhum

এক পর্যায়ে দেখা গেল, জোকের আক্রমনের মুখে ভাইস্থা আর শরিয়তের “ছোট ভাই”। জিনিসের ফাংশনালিটি রক্ষার তাগিদের সবাই ওইখানে টিস্যু বাইন্ধা আবার হাটা শুরু করলাম।

জিনাপাড়া পৌছাইলাম বিকালে। গ্রামের হেডম্যানের বাসায় থাকার বন্দোবস্ত হইলো। সারাদিনের হাটার পর গোছল কইরা এক কাপ কফি আর “ফান্ডের” বেনসন হাতে নিয়া পোষা শূকরের ডাক শুনতে শুনতে আড্ডা চলতে লাগলো। রাতে জুমের চালের ভাত, আলু ভরতা আর ডাল দিয়ে ডিনার সাইরা ঘুম।

পরেরদিনের গন্তব্য – আমিয়াখুম। ভোরে বের হয়ে প্রথমেই বিজিবি ক্যাম্পে রিপোর্ট। তারপর শুরু হইলো পাহাড়ে ওঠা-নামা। দুই ঘন্টা পর কোন্রকমে পৌছাইলাম আমিয়াখুমের আগের শেষ গ্রাম – অতিরামপাড়ায়। রেস্ট নিয়ে শুরু হইলো ট্যুরের সবচেয়ে কঠিন পার্ট।

অতিরামপাড়া থেকে নামতে হইলো শুরুতে। তারপর খাড়া ওঠা। মনে হইতেছিলো অনন্তকাল ধইরা উঠতেছি, বুকের ভিতর থেইকা হার্ট বাইর হইয়া আসতে চাইতেছিল। ফুসফুস আকুপাকু করতেছিলো বাতাসের জন্য। পা টনটন করতেছে। আর কোথাও যে দাড়ায়ে একটু রেস্ট নিবো সেই উপায় ও নাই। পাহাড় অলমোস্ট পচাশি ডিগ্রির মতো খাড়া। সামনেরজন বাশ দিয়ে ব্যালান্স রাখতে গেলেও মাটি গড়ায়ে নিচেরজনের গায়ে এসে পরতেছে।

দম বাইর হওয়া কষ্টের পর অবশেষে অপরুপা আমিয়াখুম। সৌন্দর্যের বর্ণনা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। নিজে গিয়া না দেখলে ছবি দেইখাও আসলে আইডিয়া পাইবেন না।

বৃষ্টি এড়ানোর লাইগা জানের রিস্ক নিয়া ফুল পিকাপে আবার অতিরামপাড়া। বেশ অনেকটা সময় রেস্ট নিয়ে সন্ধ্যার আগেই ব্যাক টু জিনাপাড়া। সন্ধ্যায় সবার-ই মোরাল হাই। সেই লেভেলের চিলিং হইলো। রাতে ভাতের সাথে ছোট মাছের তরকারিও জুটল কপালে।

পরেরদিন ভোর থেকে রিটার্ন জার্নি শুরু। একটানা ছয় ঘন্টা হাইটা জিনাপাড়া থেকে রেমাক্রি। ব্যাগ নিয়ে দশ মিনিটের মাথায় নৌকায়। এইবার স্রোতের দিকে থ্রিল রাইড। থানছিতে শেষ বাস মিস কইরা আবার চান্দের গাড়িতে চইড়া বান্দরবান।

বান্দরবানে টিকিট না পাইয়া গেলাম চিটাগাং। এবং আবিস্কার করলাম সেইখানে পরের রাতের ও টিকিট নাই। একটাই উপায়, অলনকার থিকা উঠলাম এক লোকাল বাসে। এবং জীবনের আজবতম বাস জার্নির অভিজ্ঞতা হয়ে গেল। বাসে উঠছিলাম আটজন, সীট ম্যানেজ করা গেল ছয়টা। দুইজন নিচে টুলের উপর কোনরকমে বসলাম।

মীরসরাইয়ে বিশাল জ্যাম। বাস একচুলও নড়ে না। রাত তিনটা। এর মধ্যে পিছনের সিটের ভদ্রলোক মোবাইলে জোরে জোরে চরমোনাইয়ের পীরের ওয়াজ ছাড়লেন। পাশের সিটের আরেক লোকের ফোন অনবরত বাজতেছে, কিন্তু তিনি ফোন ধরবেনই না। এক মহিলা আবার আমাদের একজনের রুমাল দিয়ে নির্বিকারভাবে বাচ্চার ঘাম মুছতেছে। ভোর হয়ে যায়, তাও জ্যাম শেষ হয় না। একবার দেখি বাস থাইমা আছে, পিছনের গাড়ি ওভারটেক করতেছে। হেল্পার মামার চোখে বিরক্তি। মিনিট পনেরো পরে দেখি পাশের গ্রাম থেকে টয়লেট করে বোরখা পরিহিতা একদল ভদ্রমহিলা দৌড়ায়ে আসতেছে।

ওই পরিবেশেও যখন আমি, শামীম, শৌভিক, শিপন ভাই হাসাহাসি করতেছিলাম, তখনই আসলে বুঝতে পারলাম, এই গ্রুপটার বন্ডিং আসলে কতটা স্ট্রং (সিরিয়াসলি, লাবিউ ব্রাদার্স)।

ঢাকায় পৌছাইলাম দুপুর বারোটায়। চল্লিশ ঘন্টা পেটে ভাত পড়ে নাই, চোখেও ঘুম নাই। প্রায় দেড়দিন। বাসায় গোছল দিয়ে পাচ ছয় প্লেট পোলাও মাংস সাঁটিয়া ঘুমের রাজ্যে হারায়া গেলাম।

শেষ হইলো ট্যুর ক্যারিয়ারের স্মরণীয়তম অধ্যায়…

chimbuk

(আমাদের ট্যুরের আরও ছবি দেখতে চাইলে আমার ফেসবুক এ্যালবাম থেকে ঘুরে আসতে পারেন…)

Helpful Resources:
Where to stay in Bandarban
Where to Dine in Bandarban
How to go to Bandarban from Dhaka or Chittagong