শিলং ট্রাভেল ডায়েরি পর্ব ২ – মেঘালয়ের পথে
২০১৭ তে করা আমাদের শিলং ট্রিপের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ২ পর্বের এই ডায়েরি। ১ম পর্বের পর…
৩য় দিন
এর পরের দিনটা আমরা ঝর্না, পাহাড়, লেক আর বন জঙ্গল দেখে কাটাই। যদিও শুধু ঝর্না আর পাহাড় দেখেই আমরা খুশি ছিলাম, কিন্তু Laitlum এ র সৌন্দর্য সত্যি পাগল করে দিয়েছিল আমাদের। আমাদের Laitlum যাওয়ার কোন পরিকল্পনা ছিল না, আমাদের ড্রাইভার খুব আগ্রহী ছিল ওখানে নিয়ে যেতে, কারন ওখানে বলিউড মুভির শুটিং হয়েছে। তিনি আবার বিশাল বলিউড ভক্ত। শিলং থেকে কাছেই, গাড়িতে গিয়ে কিছুদুর হেঁটে পৌঁছলাম ওখানে। পাহাড়ের উপর থেকে ছোট্ট একটা উপত্যকা দেখা যায়, সেখানে ছোট ছোট গ্রাম। মনে হয় নীল সবুজ পাহাড়গুলো মিলে গেছে একসাথে। আমরা ওখানে মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে ছিলাম অনেক ক্ষণ, মনে হচ্ছিল এই শান্ত পাহাড়ে বসে সারাদিন কাটিয়ে দেয়া যায়। সকালে স্থানীয় গির্জায় প্রার্থনা হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল বহু দূর থেকে ভেসে আসছে শব্দগুলো। ওখানে থেকে আমরা Sweet fall এ গিয়েছিলাম, মেঘালয়ের অন্য ঝর্না গুলোর মত খুব ভাল লেগেছে এই ঝরনাটাও । দুপুরে আমরা Umiyam lake এ রউনা হই। উম শব্দের অর্থ খাসি ভাষায় পানি। এজন্য এই লেক টাকে বড়পানিও বলে। জায়গাটা গোহাটি যাবার পথে। আফসোস হচ্ছিল যে সময়ের অভাবে যেতে পারলাম না। Umiyam lake টা অনেক বড়। অনেকটা আমাদের কাপ্তাই লেকের মত, কিন্তু একপাশে ওয়াটার পার্ক হওয়ায় পরিবেশটা একটু পিকনিক পিকনিক। অনেক স্কুলের বাচ্চাদের দেখলাম ওখানে, আসাম আর মেঘালয়ের বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছিল ওরা। ওখানে কিছুক্ষন বোটিং করে আমরা ফিরে এলাম।
আমরা Sacred Forest এ গিয়েছিলাম। এ জায়গাটার ব্যপারে কোন ধারনা ছিল না আগে। মূলত আগে রাজাদের আমলে প্রতি খাসি রাজ্যে একটা করে বনকে Sacred Forest বলা হত। কোন যুদ্ধ বা গুরুত্ব পূর্ণ সিদ্ধান্তের জন্য ওখানে যেত রাজা। এই বনটাকে ঠিক এভাবেই সংরক্ষণ করা হয়েছে। অনেক সুন্দর সুন্দর ফুল আর অর্কিড ছিল ওখানে। ওইদিন আমরা শিলং ফিরে যাই এর পর।
৪র্থ দিন
৪র্থ দিন আমরা ভেবেছিলাম শিলং ভিউ পয়েন্টে যাব, কিন্তু জায়গাটা ক্যান্টন্ম্যান্টে হওয়াতে ওই সময় বিদেশীদের রেস্ত্রিকশন ছিল। তাই কেউ যেতে চাইলে আগে খোঁজ নিয়ে যাওয়া ভাল। আমরা ডন বস্ক জাদুঘরে গিয়েছিলাম এরপর, ওখানকার ছাদ থেকেও বেশ সুন্দর ভিউ দেখা যায়। জাদুঘর আমার সব সময় ই ভাল লাগে, এখানেও খুব ভাল লেগেছে। সেভেন সিস্টারের সব রাজ্যের সংস্কৃতি নিয়েই এই জাদুঘর। খুব ইচ্ছা হয়েছে বাকি রাজ্য গুলোও ঘুরে দেখার। ভারতের এই দিকটা যতটা সুন্দর, আমার মতে সেই তুলনায় প্রচারটা অনেক কম। অবশ্য কিছুদিন আগেও নাগাল্যান্ড যাওয়া নিষেধাজ্ঞা ছিল। আর অরুনাচলে তো সমস্যা এখনো চলমান।
আমরা এরপর Mawlinong village এ গিয়েছিলাম, এশিয়ার Cleanest village নামে পরিচিত এই গ্রাম। গ্রামটা একদমই বাংলাদেশের কাছাকাছি, বেশ সুন্দর আর গোছালো, তবে আমাদের কাছে আলাদা লাগে নি তেমন। সিলেটের সাধারণ একটা পাহাড়ি গ্রামের মতই লেগেছে। এই অঞ্চলে অনেক জায়গার নাম পাবেন “মাও” দিয়ে শুরু। মাও শব্দের অর্থ খাসি ভাষায় পাথর। তাই এক একটা গ্রামের নামে এই শব্দটা খুব পাওয়া যায়। আমরা এই গ্রামেই Root Bridge দেখেছিলাম এরপর। রুট ব্রিজ মেঘালয়ের অনেক পুরানো ঐতিহ্য। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে যোগাযোগের জন্য আগে তেমন কোন উপায় ছিল না। সুবিধার জন্য এখানকার লোকেরা নদীর দুপাশে গাছ লাগাতো, বট গাছ বা বিভিন্ন জাতের রাবার গাছ গুলোর শিকড় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে একেকটা সেতু তৈরি করত। Riwai Living Root Bridge এমনই একটা অসামান্য শিল্প, যা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। এই Root Bridge টা প্রায় ৩০০ বছরের পুরানো। যদিও চেরাপুঞ্জির কাছে Double Decker Living Root Bridge সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটকদের কাছে, কিন্তু ওখানে যাওয়াটা বেশ কষ্ট সাধ্য, প্রায় ৫ ঘণ্টা হাঁটার পথ। তবে রিওয়াই আমাদের মোটেও নিরাশ করে নি। Root Bridge , নিচে বয়ে চলা স্বচ্ছ নদী, দুপাশে সুন্দর গ্রাম, সব মিলিয়ে সত্যিই অসাধারণ।
৫ম দিন
এইদিন আমাদের ফেরার পালা। এজন্য লম্বা চওড়া কোন প্লান করা হয় নি। সকালে নাস্তা করে আমরা শিলং শহরকে বিদায় দিয়ে রওনা হলাম ডাউকির দিয়ে। ছবির মত সুন্দর উমগট নদীতে বোটিং করে আমরা ফিরে আসবো। কিন্তু আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড পরামর্শ দিলেন স্নংপডেং সহ ঘুরে যেতে। ভাগ্যিস লোকটা বলেছিল! নইলে যাওয়াই হতো না স্নংপডেং। জায়গাটা পাহাড়ের ভিতর একটা গ্রাম, একদম খরস্রোতা নদীর পাশে। কায়াকিং আর ক্যাম্পিঙের জন্য একদম দারুন। প্রচুর মানুষকে দেখলাম ক্যাম্পিং করতে এসেছে। নদীর পাড়ে থাকার জায়গাও আছে ওখানে। একটা লোহার ঝুলন্ত সেতু আছে, বেশ বড় সেতুটা। মনে হচ্ছিল এখানে একদিন থেকে মাছ ধরে আর কায়াকিং করে কাটিয়ে দিতে পারলে অসাধারণ হত। যাইহোক, আফসোস করার চেয়ে ভাল লাগাটা নিয়ে থাকাই ভাল।
এরপর আমরা ডাউকি যাই। একদম জাফলং এর যেই জায়গাটায় আমরা বেড়াতে যাই, ওখানটায় বর্ডারের ওপারের দৃশ্যটা একদমই আলাদা। দুপাশের পাহাড়, কখনো কখনো গুহার মত, বেশ পাখির ডাক শোনা যায়, আর একদমই স্বচ্ছ পানি। আমাদের জাফলং টাও নিশ্চয়ই এমন ছিল, কিন্তু অসচেতনতায় আর এমন প্রাকৃতিক নেই। ডাউকিতে কোন ইঞ্জিন চালিত নৌকা নিষিদ্ধ, এমন কি জাল দিয়ে মাছ ধরা পর্যন্ত। অনেকেই ওখানে মাছ ধরছিল ছিপ দিয়ে। আবার পাশেই একদম টাটকা মাছ ভাজি বিক্রি হচ্ছিল। ওখানটায় বেশ কিছুক্ষন কাটিয়ে আমরা আমাদের ভ্রমণ শেষ করলাম, রওনা হলাম তামাবিলের উদ্দেশ্যে।
কিভাবে যাবেনঃ শ্যামলী পরিবহনের বাস আছে যারা ঢাকা থেকে সরাসরি শিলং নিয়ে যায়। সেভাবে যেতে পারেন, আবার আমাদের মত যদি ঘুরে ঘুরে সব দেখে যেতে চান তাহলে ঢাকা থেকে সিলেট পর্যন্ত বাস বা ট্রেনে গিয়ে তামাবিল পর্যন্ত সিএন জি বা বাসেও যেতে পারেন। এরপর বর্ডার পার হয়ে নিজে গাড়ি ভাড়া নিতে পারেন, আবার শেয়ার করেও যেতে পারেন শিলং। আমরা যেই গাড়িটা নিয়েছিলাম সেটার ভাড়া ছিল ১২০০ রুপি।
খরচঃ আমরা দুজন ঢাকা থেকে সিলেট এসি বাসে যাতায়াত করেছিলাম। তারপর সিলেট থেকে তামাবিল যাবার পথে সিএনজি আর আসার পথে বাসে এসেছি। শিলং থেকে সব জায়গায় ভাড়া করা গাড়িতে যাতায়াত করেছি আর হোটেলে খরচ হয়েছে প্রতিরাতে ৪০০০ রুপি। সব মিলিয়ে ৫ দিনে ( ব্রিহঃ স্পতিবার রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল) আমাদের জনপ্রতি ২০,০০০ টাকা খরচ হয়েছিল।
সুবিধা অসুবিধাঃ শিলংয়ে শপিং করার তেমন কোন সুযোগ নাই, একদমই পাহাড়ি শহর। আর আপনি যদি সিটি লাইফ বা হৈচৈ খুব পছন্দ করেন সেটি খুব বেশি পাবেন না। খাবার ভাল লেগেছে , একদমই বাংলাদেশের মত, সস্তাও। প্রচুর সিলেটী লোক পাবেন এখানে। আর পুরো ভারতের সব রাজ্যের লোক তো আছেই। হাঁটার উপযোগী জামা, জুতা নিলে আপনার ভ্রমণ উপভোগ্য হবে। যে কোন সময়েই হালকা শীতের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাওয়া ভাল।